চেক ডিজঅনারের মামলা 

আজিম আর করিম দুই জন বাল্য বন্ধু । তাদের অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু মাত্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নয় বিশ্বাসের সম্পর্ক বিদ্যমান । করিম একদিন আজিমের কাছে এসে বললো বন্ধু আমার ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে দুই লক্ষ্য টাকা খুব প্রয়োজন এবং আরো বললো যে সে আগামী সপ্তাহে এই টাকা পরিশোধ করবে। করিম তার বুক পকেট থেকে একটি চেকের পাতা স্বাক্ষর করে দিয়ে আজিমকে বললো আগামী সাপ্তাহে সে এই চেক ব্যাংকে জমা দিলে সে এই দুই লক্ষ্য টাকা ফেরত পাবে।

করিম আজিমের এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু যে আজিম তার কথায় না করতে পারলো না। তাই আজিম তার কষ্টার্জিত জমানো টাকা থেকে দুই লক্ষ্য টাকা করিমকে দিয়ে করিমের কাছ থেকে চেকটি গ্রহন করে।পরবর্তী সপ্তাহে আজিম ব্যাংকে চেকটি জমা দিলে ব্যাংকের কর্মকর্তা তাকে বলে যে করিমের একাউন্টে প্রর্যাপ্ত টাকা জমা না থাকায় তাকে চেকের টাকা প্রদান করা সম্ভব নয়। আজিম হতাশ হয়ে করিমকে ফোন করে কিন্তু করিম আজিমের কোন ফোন রিসিভ করে না। আজ প্রায় চার মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু করিম আজিমের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করে না এমনকি কথাও বলে না।

দুই বন্ধুর মাঝে এতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখন তা শত্রতায় রুপান্তর। আজিম এখন চাই করিমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নিতে এবং তার কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পেতে । আজিম তাই সিএলপি (CLP) এর নিকটে চেক ডিজঅনারের মামলা করতে এবং আইনগত প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাই।

চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করার পূর্ব শর্ত:

  • নিদ্দিষ্ট সময়ের মাঝে চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দেতে হবে অথাৎ চেক ইস্যু করার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে।
  • ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক ডিজঅনারে সময় থেকে ৩০ দিন এর মাঝে চেক দাতাকে টাকা পরিশোধের জন্য লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করতে হবে।
  • চেক দাতা নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের ভিতরে চেকে উল্লেখিত টাকা চেক গ্রহিতাকে পরিশোধ না করলে তখন চেক গ্রহিতা মামলা করতে পারবে।

চেক ডিজঅনার মামলা লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার পদ্ধতিঃ

ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক ডিজঅনারে হলে ৩০ দিন এর মাঝে চেক দাতাকে টকা পরিশোধের জন্য লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করতে হবে। লিগ্যাল নোটিশ তিন ভাবে দেওয়া যেতে পারে।

  • নোটিশ গ্রহিতার হাতে সরাসরি নোটিশ প্রদান করে।
  • ডাকযোগে চেক প্রদানকারীর ঠিকানায় এবং সর্বশেষ বসবাসের ঠিকানায় প্রাপ্তি স্বীকারপত্র সহ নোটিশ প্রদান করে।
  • সর্বশেষ কোনো জাতীয় বাংলা দৈনিকে নোটিশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে।এ তিন পদ্ধতির যে কোন একটা পদ্ধতি অনুসরণ করলে হবে। 

চেক ডিজঅনার মামলা করার জন্য যে সকল কাগজ প্রত্র আদালতে দাখিল করতে হবেঃ 

১। মামলার আরজী/ দরখাস্ত।

২। লিগ্যাল নোটিশ এর ফটোকপি ।

৩। লিগ্যাল নোটিশ প্রেরনের ডাক রশিদ এবং এ.ডি এর ফটোকপি।

৪। মূল চেকের ফটোকপি।

৫। ডিসঅনার স্লিপ এর ফটোকপি।

৬। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র।

চেক ডিজঅনার কোথায় মামলা করবেঃ

অভিযোগ বা নালিশি মোকাদ্দমা সি.আর মামলা হিসেবে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। মামলা দায়ের করার সময় আদালতে মূল চেক, ডিজঅনারের রশিদ, লিগ্যাল নোটিশ, পোস্টাল রশিদ, প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ আদালতে প্রদর্শন করতে হবে। এসবের ফটোকপি ফিরিস্তি আকারে মামলার আরজীর সঙ্গে আদালতে জমা করতে হবে। আদালত মোকাদ্দমাটি গ্রহন করলে বিবাদীর নামে সমন অথবা ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলা গ্রহন করলেও মামলাটি মূল বিচার করা হয় দায়রা আদালতে।

চেক ডিজঅনার মামলায় আজিমকে যে সকল বিষয় প্রমান করতে হবেঃ

চেক ডিজঅনারের মামলায় বাদীকে অনেক বিষয় প্রমান করতে হয় এবং সে সকল বিষয় প্রমান করতে পারলে আসামীকে শাস্তি দেওয়া যাবে ।

১। আসামী বাদীকে চেক প্রদান করেছে ।

২। ঋণ বা দায়-দেনা পরিশোধের জন্য আসামী বাদীকে চেক প্রদান করেছে।

৩। ঋণ বা দায়-দেনা আসামী আইনুগভাবে পরিশোধ যোগ্য।

৪। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক ডিজঅনার হয়েছে।

৫। চেক ডিজঅনারে সময় থেকে ৩০ দিন এর মাঝে আসামীকে টাকা পরিশোধের জন্য

লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।

৬। আসামী নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের ভিতরে চেকে উল্লেখিত টাকা বাদীকে পরিশোধ ব্যর্থ হয়েছে।

৭। আসামী ব্যাবসায়িক লেনদেনের কারনে বাদীকে চেক প্রদান করলে বাদীকে আসামীর সাথে  তার ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিল প্রমান করতে হবে।

চেক হারিয়ে গেলে কি করবেনঃ

চেক হারিয়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব আপনার নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি সাধারন ডাইরী (জিডি) করবেন। অথবা আপনার চেক যে স্থানে হারিয়ে গিয়েছে তার নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি সাধারন ডাইরী (জিডি) করতে পারেন। জিডির সত্যায়িত কপি হিসাবধারী ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংক এর সংশ্লিষ্ট শাখায় উপস্থিত হয়ে জিডির কপিটি জমা দেবেন। এক্ষত্রে আপনার হারিয়ে যাওয়া চেক দিয়ে কেও আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারবে না। আর আপনি যদি চেক ডিসঅনারের মামলা দায়ের করার পর মূল চেক, ডিজঅনারের রশিদ, পোস্টাল রশিদ, প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ হারিয়ে ফেলেন তাহলে যে স্থানে হারিয়ে গিয়েছে তার নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি সাধারন ডাইরী (জিডি) করতে পারেন হবে। আপনার মামলার সাক্ষ্য গ্রহন সহ অনেক ক্ষেত্রে  জিডির সত্যায়িত কপি প্রয়োজন হবে।

আবার চেক ডিসঅনার হয়ার পর ডিসঅনার স্লিপ সহ চেক হারিয়ে গেলে এ বিষয়ে থানায় জিডি করে ১৩৮ ধারায় মামলা করা হয় তাহলে মামলার বাদীকে সাক্ষ্যকে সমর্থন করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিলে ধরে নেয়া হয় যে বাদী তার মামলায় উক্ত বিষয়ে প্রমানে সক্ষম হয়েছেন।

চেক ডিজঅনারের মামলায় বাদী/আসামী মৃত্যু হলেঃ

চেক ডিজঅনারের মামলায় বাদী/আসামী কোন এক পক্ষ মারা গেলে মামলাটি শেষ হয়ে যায় অনেকে মনে করেন। ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনারের মামলায় এমনটি ঠিক নয়। চেক ডিজঅনারের মামলা অন্য সকল ফৌজদারী মামলা থেকে একটু আলাদা এবং এটি কিছুটা দেওয়ানী প্রকৃ্তির হওয়ায় বাদী অথবা আসামীর মৃত্যুর কারনে মামলা শেষ হয়ে যায় না। বাদীর মৃত্যুর পর তার বৈধ প্রতিনিধি মালার বাদী প্রক্ষভুক্ত হয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারবে। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় আসামীর মৃত্যু হলে মামলার আরজী সংশোধন করে মামলা চলানো যায়। মামলা চলমান অথবা মামলা করার পূর্বে আসামীর মৃত্যু হলে বাদীর একমাত্র প্রতিকার হলো আসামীর বৈধ প্রতিনিধি বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতে টাকা আদায়ের মামলা করে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা।

চেক ডিজঅনারের মামলায় অপরাধের শাস্তিঃ

সকল সাক্ষ্য প্রমান, জেরা, যুক্তিতর্কের পর আদালত রায় প্রদান করবেন। অপরাধ প্রমান হলে আইন অনুসারে শাস্তি হিসেবে এক বছর কারাদন্ড অথবা চেকে উল্লেখিত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করতে পারেন।

চেক ডিজঅনারের মামলায় আপিলঃ

আদালতের রায়ের পরে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় প্রদও দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে। দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজের দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করতে হবে এবং যুগ্ম দায়রা জজের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজের নিকট আপীল করা যাবে।

চেক ডিজঅনারের মামলায় আপীল করার পূর্বশর্তঃ

১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় প্রদও দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা্র আগে দন্ডাদেশের উল্লেখিত অর্থের ৫০% আদালতে জমা দিয়ে আপীল করতে হবে। ৫০% টাকা বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে অর্থাৎ যে আদালত শাস্তি প্রদান করেছেন সে আদালতে টাকা জমা দিতে হবে।

You may also want to know: সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা কেন জরুরি এবং কিভাবে করবেন

সিএলপি কর্তৃক চেক ডিসঅনারের মামলা সম্পর্কিত আইনী সেবা:

সিএলপি একটি সনামধন্য ‘ল’ চেম্বার যেখানে ব্যারিস্টারস এবং আইনজীবীদের মাধ্যমে চেক ডিসঅনারের মামলা সম্পর্কিত সকল প্রকার আইনগত সহায়তা, পরামর্শ প্রদান করে থাকে। কোন প্রশ্ন বা আইনী সহায়তার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুনঃ-ই-মেইল: info@counselslaw.com  ফোন: +8801700920980 +8801947470606, ঠিকানা: জামিলা ভিলা, ফ্ল্যাট-২সি, বাসা-৪/এ/১ (তৃতীয় তল), রোড-০২, গুলশান -১, ঢাকা-১২১২।

 

Call Now

error: Content is protected !!